"রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ গল্পগুচ্ছ আশ্চর্য বই। ইতিহাসের দিক থেকে আশ্চর্য, আন্তরিক মূল্যেও তা-ই। বাংলা ভাষায় প্রথম ছােটোগল্প লেখেন রবীন্দ্রনাথ এবং এমন সময়ে লেখেন, যখন ইংরেজি সাহিত্যেও ছােটোগল্প নামক বস্তুতির চল হয়নি। সমগ্র গল্পগুচ্ছ প'ড়ে উঠলে আমাদের মনকে প্রবলভাবে এই কথাটাই আঘাত করে যে এর বেশির ভাগ গল্প আক্ষরিক অর্থে বাস্তব সারা বাংলাদেশটাকে পাওয়া যায় এখানে। যে বাংলাদেশ শুধু বাস্তবও নয়, জীবন্ত, তারই হৃৎস্পন্দন এর পাতায়-পাতায় আমরা শুনতে পাই। তার ঋতুবৈচিত্র্য, তার প্রাণপ্রতিম নদীস্রোত, তার প্রান্তর, বাঁশবন, চণ্ডীমণ্ডপ, রথতলা, তার স্নিগ্ধ আর্দ্র ঘন উদ্ভিজ্জ গন্ধ, তার দুরন্ত কলােচ্ছ্বসিত পল্লীপ্রাণ। বালক-বালিকা, সেবানিপুণা কল্যাণী বুদ্ধিমতী গৃহিণী, নধর গােলগাল পরিতৃপ্ত পান-তামাক আডডায় আসক্ত ভালােমানুষ পুরুষ, প্রাচীন যুগের ক্ষয়িত অভিজাত, নবীন যুগের কর্মঠ ব্যবসায়ী, প্রথম স্বদেশী আন্দোলন, অসহযােগ আন্দোলন, সামাজিক বিপ্লব, শেষ-উনিশ ও প্রথম-বিশ-শতকের আধুনিকতা, বাংলার সুখ-দুঃখ, হাস্যপরিহাস, আচার-সংস্কার, তার ভয়, লােভ, লজ্জা, তার শক্তি, তার ব্যর্থতা—সব ধরা পড়েছে গল্পগুচ্ছ-এ : পুরুষের নির্বোধ দাম্ভিক আত্মকেন্দ্রিকতা, তাও আছে, আছে বালিকা-বধূর নিঃশব্দ দুঃসহ বেদনা, আছে আত্মবশ আধুনিকার দীপ্ত মূর্তি। মনে হয় যেন এই গল্পগুলির ভিতর দিয়ে বাংলাদেশই কথা কয়ে উঠছে বারবার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।