দীর ঘাটে পর পর পাট বোঝাই বিরাট বিরাট নৌকো। একটার পর একটা। ঘাটে আর জায়গা নেই বলে ভৈরবের মাঝ গাঙ অব্দি নৌকোর সারি। চওড়া হাল। এক এক নৌকোয় তোলা উনুনে ঝাল দিয়ে শুঁটকি মাছের চচ্চড়ি হচ্ছিল। বাতাস এসে সে-গন্ধ ঘাটে দাঁড়ানো লোকজনের নাকে এসে লাগল। তাদের ভেতর জুবিলি স্কুলের কালাচাদ প্রামাণিক ছিল। ক্লাস সেভেন। রোল ইলেভেন। গন্ধ ওঁকেই খিদে পেয়ে গেল কালাচাদের।
আজ সারাদিন বিশেষ কিছুই খায়নি কালাচাদ।
সকালে জলখাবার খায়নি। খাওয়া হয়নি। মার খেয়েছে বাবার হাতে।
দুপুরে স্কুলে যাওয়ার আগে ভাত খায়নি। খাওয়া হয়নি। মার খেয়েছে মায়ের হাতে। স্কুলে টিফিন খায়নি। খাওয়া হয়নি। মার খেয়েছে ইতিহাসের স্যারের হাতে। এখন বিকেল বেলা। আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সন্ধে হবে। বাড়ি গিয়ে পড়তে বসতে হবে। ঘণ্টা দুই চেঁচিয়ে রিডিং পড়লে তবে বাবা খেতে ডাকবে।
ঘরে বাইরে কালাচাদের এখন এত সুনাম—কেউ আর তাকে এমনিতে কিছু দেয় না। যা দেয়—তার নাম মার। হাতের সুখ করে মারে সবাই তাকে। বাবা মেরেছে পিঠের জামা তুলে। মা মেরেছে চাবির গোছা দিয়ে। ইতিহাস স্যার বেত দিয়ে। বাঁ হাতে চার বেত। ডান হাতে চার বেত। মারতে মারতে বলেছেন, এইভাবে মেরে তোর চরিত্র পাল্টাবো। বেত খেয়ে খেয়ে তুই শুদ্ধ হয়ে যাবি। হাতের রেখা মুছে গিয়ে তোর হাতে নতুন রেখা গজাবে। তখন তুই নতুন মানুষ। চাই কি বিদ্যাসাগর হবি। চাই কি রবীন্দ্রনাথও হতে পারিস। তোর ভাবনা কিসের। নে হাত পাত। আরেক যা মারি।
Shyamal Gangopadhyay (২৫ মার্চ, ১৯৩৩ - ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০০১) একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক ও সম্পাদক ছিলেন। ছদ্মনাম- বৈকুন্ঠ পাঠক। সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম অবিভক্ত ভারতের খুলনা্তে(অধুনা বাংলাদেশ)। তার পিতার নাম মতিলাল ও মাতা কিরনবালা। খুলনা জিলা স্কুলে তার প্রাথমিক শিক্ষা। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে তার পরিবার কলকাতায় চলে আসে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং বেলুড়ে ইস্পাত কারখানার কাজে যোগ দেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে স্নাতক পাশ করে চেতলায় শিক্ষকতার চাকরিও করেন কিছুকাল। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন, ১৯৬১ সালে আনন্দবাজারে যোগ দেওয়ার পর তার ছোটগল্প হাজরা নস্করের যাত্রাসঙ্গী, ধানকেউটে ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। তার প্রথম উপন্যাস বৃহন্নলা, কিন্তু দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে কুবেরের বিষয় আশয় প্রকাশিত হওয়ার পরেই শ্যামলের লেখনী বাংলা পাঠকমহলে সমাদৃত হয়। ব্যক্তিজীবনে বোহেমিয়ান, সুরসিক ও আড্ডাবাজ ছিলেন তিনি। আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর অন্যতম কর্তা সন্তোষকুমার ঘোষের সাথে তার মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি যুগান্তরে যোগ দেন। যুগান্তরের সাহিত্য পত্রিকা অমৃত সম্পাদনা করতেন। দেশভাগের ওপর রচিত তার উপন্যাস আলো নেই। তার শেষ উপন্যাস হল গঙ্গা একটি নদীর নাম। ১৯৯০ সালে অবসরের পরে আজকাল পত্রিকা ও সাপ্তাহিক বর্তমানে নিয়মিত লিখতেন তিনি। গ্রামীন জীবন, চাষবাস, সম্পর্কের জটিলতা ইত্যাদি শ্যামলের রচনার বৈশিষ্ট্য। ছোটদের জন্যে সাধু কালাচাদের গল্প, ভাস্কো ডা গামার ভাইপো, ক্লাস সেভেনের মিস্টার ব্লেক ইত্যাদি বই লিখেছেন। ১৯৯৩ সালে শ্যামল সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন তার বিখ্যাত উপন্যাস শাহজাদা দারাশিকোহ বইটির জন্যে। তার সম্পাদিত গ্রন্থ বাংলা নামে দেশ। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা দেশ বিদেশের নানা ভাষাতে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।