উপক্রমণিকা না উপসংহার?* ‘পৃথিবী গ্রহের যাবতীয় প্রাণী-প্রজাতির মধ্যে সবথেকে চিত্তাকর্ষক এবং সবথেকে বিরক্তিকর হচ্ছে মানুষ, অথবা তার নিজের উদ্ধত ভাষায় — হোমো স্যাপিয়েন্স্।' মঙ্গলগ্রহের কোনও দার্শনিক মনোভাবাপন্ন জীববিজ্ঞানী যদি আমাদের এই গ্রহের উদ্ভিদকুল ও প্রাণীকুল সম্বন্ধে একটি প্রতিবেদন লিখতেন, তাহলে সেই প্রতিবেদনের শেষ পরিচ্ছেদের প্রথম বাক্যটি হয়তো এ-রকমই হত। আমরা নিজেরা এই গ্রহের সঙ্গে মানসিক ও প্রবৃত্তিগত নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ বলে ভিন গ্রহের কোনও পর্যবেক্ষকের মতো নির্মোহ মন এবং সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি অর্জন করা আমাদের পক্ষে দুরূহ। কিন্তু মাঝেমধ্যে আমাদের ওই কাল্পনিক মঙ্গলবাসীটির মতো গভীর পর্যালোচনায় ব্যাপৃত হওয়াও দরকার আর সেই পর্যালোচনার আলোয় বিচার করে দেখা দরকার আমাদের প্রজাতির অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎকে (অবশ্য যদি আদৌ কোনও ভবিষ্যৎ থেকে থাকে)। সেইসঙ্গেই বিচার করা দরকার পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বের ব্যাপারে মানুষ ভাল-মন্দ যা-কিছু করেছে, করে চলেছে এবং আগামীদিনে করতে পারে, আর হয়তো ভবিষ্যতে অন্য কোনও গ্রহের জীবনে যা-কিছু সে ঘটাতে পারে—তার মূল্যকে। এ-ধরনের সমীক্ষায় অস্থায়ী আবেগের কোনও গুরুত্ব থাকে না, ঠিক যেমন বিমান থেকে নীচের দিকে তাকালে ছোট-ছোট পাহাড়গুলিকে সমতলভূমি বলেই মনে হয়। অন্যদিকে, স্থায়ী মূল্যবিশিষ্ট আবেগগুলি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ চেহারা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।
(১৮ মে ১৮৭২ – ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০) ছিলেন একজন ব্রিটিশ দার্শনিক, যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজকর্মী, অহিংসাবাদী, এবং সমাজ সমালোচক.যদিও তিনি ইংল্যান্ডেই জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন, তার জন্ম হয়েছিল ওয়েলস এ, এবং সেখানেই তিনি ৯৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। রাসেল ১৯০০ সালের শুরুতে ব্রিটিশদের আদর্শবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাকে বিশ্লেষণী দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়, এর অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন তার শিষ্য ভিটগেনস্টেইন এবং পূর্বসূরি ফ্রেগে এবং তাকে ২০ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম যুক্তিবিদদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাসেল এবং হোয়াইটহেড একত্রে প্রিন্কিপিয়া ম্যাথমেটিকা নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তারা গণিতকে যুক্তির ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তার দার্শনিক নিবন্ধ "অন ডিনোটিং" দর্শনশাস্ত্রে মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়। দুটো গ্রন্থই যুক্তি, গণিত, সেট তত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত যুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিত্ব এবং জাতিসমূহের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যে বিশ্বাস করতেন। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। রাসেল তার অহিংস মতবাদ প্রচারের জন্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জেলবন্দী হন, তিনি হিটলারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান, সোভিয়েত টোটালিটারিয়ানিজম এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণের সমালোচনা করেন এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। রাসেল ১৯৫০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন, যা ছিল "তার বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ রচনার স্বীকৃতিস্বরূপ যেখানে তিনি মানবতার আদর্শ ও চিন্তার মুক্তিকে ওপরে তুলে ধরেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিরোধীর ভূমিকা নেন, ফলস্বরূপ তাঁকে ছ'মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। সেই সঙ্গে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক পদ থেকে বরখাস্ত হন। ১৯৫০ সালে পারমানবিক নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে আন্দোলন সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এই কারণে ১৯৬১ সালে তাঁকে আবার কারাদনণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ১৯৭০ সালে বারট্রান্ড রাসেল মৃত্যুবরণ করেন।