রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বিশ্বসাহিত্যের এক বিপুল বিস্ময়। বিশ্ববাসী টেগোরকে কবি হিসেবেই জানে। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় রবীন্দ্রনাথের যে মহীয়ান অধিকার—তা রবীন্দ্রসাহিত্যের ব্যাপক অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বনাগরিককে জানানোর সময় এসেছে। 'পুনশ্চ' কাব্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ গদ্যছন্দে কবিতা লেখার সফল নিরীক্ষা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের 'পুনশ্চ' কাব্যের 'কোপাই' (১৯৩২ : ১৩৩৯) কবিতার মধ্যে কবি তাঁর প্রতিবেশিনী হিসেবে অভিহিত করেছেন কোপাই নদীকে। কবিতাটির প্রথমে কবি পদ্মানদীর কথা লিখেছেন। কবি মনে মনে পদ্মানদীকে দেখেন বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু মনে মনে এবং গভীর-সুন্দর-ভালোবাসাময়ভাবে তিনি যে কোপাইকে অনুভব করেন—তার প্রমাণ আমরা কবিতাটির পরতে পরতে পাই। পদ্মার পাড়ে দেড়শো বছর পূর্বেকার নীলকুঠির ভাঙাভিত রয়েছে। সেখানে রয়েছে রাজবংশীদের পাড়া। কোপাই নদীর চিত্রণে কবির অন্তর-অস্তিত্ব প্রেমময়তায় সিক্ত হয়েছে। 'ছায়াবৃত সাঁওতাল-পাড়ার পুঞ্জিত সবুজ' এর প্রচ্ছায়া নিয়ে এই নদী। 'কতকালের সাঁওতাল নারীর হাস্যমুখর কলভাষা’—কোপাই এর সঙ্গে জড়িত বলে কবি মন্তব্য করেন। নদীটির এপারের সঙ্গে ওপারের কথা চলে সহজে। ওর ভাষা হলো গৃহস্থপাড়ার ভাষা; জল স্থল, বাঁধা পড়েছে—যার ছন্দে; যেখানে ভাষার গানই শুধু নেই; আছে ভাষার গৃহস্থালি। নটীর অলঙ্কারের ঝংকার দিয়ে নাচা এবং ক্লান্ত হয়ে আলস্য চাহনির দৃষ্টিপাতের মধুরতা যেন কোপাই এর নন্দনভাষ্য। নাটক (১৯৩২ : ১৩৩৯) কবিতাটিতে অর্জুন ও উর্বশীর প্রসঙ্গ রয়েছে। অর্জুন উর্বশীকে বলেছেন যে, উর্বশীর আছে অনিন্দিত মাধুরী। উর্বশী অর্জুনকে বলেছে তার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কামলাস্যে তাকে বরণ করার জন্যে। পদ্যকে এই কবিতায় সমুদ্র হিসেবে অভিহিত করে, তার বৈচিত্র্য যে ছন্দতরঙ্গে ও কলকল্লোলে তা তিনি স্পষ্টায়িত করেছেন। গদ্য যে বাঁধা ছন্দের বাইরে আসর জমিয়েছে—তা-ও কবি এই কবিতায় বলেছেন। গদ্যের আঙিনায় আছে সুশ্রী-কুশ্রী ও ভালো-মন্দের মহড়া। ‘পুনশ্চ' কাব্যটিতে রবীন্দ্রনাথ গদ্যছন্দ নিয়ে যে পরীক্ষা করেছেন—তারই অনুষঙ্গাবৃত হয়ে কবির উপর্যুক্ত মন্তব্যাবলি কবিতাটিতে ভাষ্যরূপ লাভ করেছে। ‘নূতন কাল’ কবিতায় কবি তাঁর প্রেয়সীর করুণ প্রত্যাশা'কে পূর্ণ করার জন্য তাঁর বাণীকে প্রেমিকার বাণীর অলঙ্কারে সাজ পরিয়ে দিয়েছেন। কবিপ্রিয়া কবিকে প্রাণের টানে বিশ্বাস করেছিলো বলে কবি সেই বিশ্বাসের মূল্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কবিপ্রেয়সী নতুনকালে না থেকে বরং পুরাতন সময়ের চিরন্তনতার মধ্যে মিশে গেছেন। শিল্প তো সময়জয়ী এক চিরন্তনতা—একথাই কবিতাটির মৌলভাষ্য। ‘পত্র’ (১৯৩২ : ১৩৩৯) কবিতায় কবি ১৯৩০ এর দশকের কবিতা যে ছাপাখানার মায়ায় কাব্যগুণ হারাতে বসেছে, সেজন্য দুঃখ ও বেদনা প্রকাশ করেছেন। 'চোখ বুজে কান পেতে’ কবিতা শোনার মত কবিতামগ্নতা পাঠকের মধ্যে আর সৃষ্টি হয় না। 'নিশীথ রাতের তারাগুলি ছিঁড়ে নিয়ে' হার গাঁথার মতো নান্দনিক সুন্দরতা কবিতা থেকে নির্বাসিত হয়ে যাচ্ছে বলে কবির বড় দুঃখ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।