এক নৌকাডুবি মানুষকে সামাজিকভাবে কতটা বৈচিত্র্যময় করে তোলে তার নিদারুণ কাহিনিই চিত্রিত হয়েছে 'নৌকাডুবি' উপন্যাসে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রমেশ। রমেশের বন্ধু যোগেন্দ্র। যোগেন্দ্রর ছোট বোন হেমনলিনী। হেমনলিনী আর রমেশ- দুইজনেই পরস্পরের প্রতি দুর্বল ছিল। বাবার আদরের কন্যা হেমনলিনী। সবাই ভালোবেসে ডাকে হেম। রূপে-গুণে অতুলনীয় এ তরুণীর হৃদয় জয় করে বড় ভাই যোগেন্দ্রর বন্ধু রমেশ। কিছুদিন পর হেমের জন্মদিন। রমেশ চিঠিতে জানায়, সেদিনই সে হেমের বাবার কাছে তাদের বিয়ের প্রস্তাব দেবে। রমেশ কলকাতায় আইন পড়তে গিয়ে পরিচয় ঘটে হেমের সাথে। রমেশ ও অক্ষয় প্রায়ই অন্নদাবাবুর বাড়ি যেত। হেমের প্রতি রমেশ আকৃষ্ট ছিল। এদিকে হেমের বাবা মেয়ের হৃদয়ের কথা আগেই টের পেয়েছেন এবং এ নিয়ে তার কোনো আপত্তিও নেই। হেমের জন্মদিনে হেম, হেমের বাবা অন্নদাবাবু, দাদা যোগেন্দ্র-সবাই রমেশের প্রতীক্ষায় থাকে। সারারাত কেটে যায় কিন্তু রমেশের দেখা নেই। মুখে কিছু না বললেও হেমের মনের অবস্থা বুঝতে কারো বাকি থাকে না। অবশ্য তার এই অভিমান বেশিক্ষণ থাকে না। সে জানতে পারে, বাড়ি থেকে জরুরি চিঠি পেয়ে রমেশ বাড়ি গিয়েছে। চিঠিটা পাঠিয়েছে তার বাবা। এদিকে বাড়ি ফিরে রমেশ জানতে পারে বাবা তার মৃত বন্ধুর মেয়ে সুশীলার সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে। সে বাবাকে হেমের কথা বলে এবং বিয়েতে ঘোর আপত্তি জানায়। রমেশের বাবা তার কোনো কথাই শোনে না। তাই সে বাড়ি ছেড়ে কলকাতা চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। বাবা তাকে ত্যাজ্য করবে শুনেও সে পিছপা হয় না। কিন্তু বাইরে দাঁড়ানো অসহায় বিধবা মহিলা (যার মেয়ের সঙ্গে রমেশের বিয়ে ঠিক হয়েছে) তাকে জানায় বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। এই অবস্থায় বিয়ে না হলে তাদের মা-মেয়েকে বিষ খেয়ে মরতে হবে। তবুও তিনি চান না তাদের পিতা-পুত্রের সম্পর্ক নষ্ট হোক। তার কথা শুনে রমেশ আর ফিরতে পারল না। আবার কথাটা হেমকে জানানোর মতো সাহসও তার হয়ে উঠল না। নির্ধারিত দিনে বিয়ে সম্পন্ন হয়। বরযাত্রী নৌকা দিয়ে ফিরছে। এমন সময় হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। প্রচণ্ড ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বরযাত্রীদের নৌকার বহর। রক্ষা পায় শুধু রমেশ আর সুশীলা। সময়ের সাথে সাথে রমেশ যাকে সুশীলা ভেবেছিল তার মধ্যে অনেক অসামঞ্জস্যতা দেখতে পায়। সুশীলার ভাষ্যমতে তার স্বামী ডাক্তার। কিন্তু রমেশ একজন উকিল। তাছাড়া সে জানায় তার নাম কমলা। রমেশ কৌশলে জানতে পারে সে মামার কাছে মানুষ হয়েছে, তার বাবা-মা মৃত এবং স্বামীর নাম নলিনাক্ষ। রমেশ বুঝে যায় সে তার স্ত্রী নয়। ঝড়ের সময় তাদের পাশাপাশি আরো একটি নৌকাডুবি হয়-যার হতভাগ্য শিকার কমলা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।