‘শব্দতত্ত্ব’ বইটিতে রবীন্দ্রনাথের প্রায় সারাজীবনের ভাষাচিন্তা, মতান্তর, বিশ্লেষণ-প্রবণতা, ধারণার বিবর্তন ইত্যাদি মুদ্রিত হয়ে আছে। মূলত এখানে বাংলাভাষার স্বভাব ও স্বাতন্ত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করা হয়েছে। একদিকে ভাষার সর্বাঙ্গীণ রূপ সম্বন্ধে পাশ্চাত্য ভাষাবিজ্ঞানীসুলভ সচেতনতা, অন্যদিকে বাংলাভাষার বিশ্লিষ্ট প্রকৃতি সম্বন্ধে তীক্ষ্ণ বোধ- রবীন্দ্রনাথের এই বইটি সমস্ত পণ্ডিতি আলোচনা থেকে এক অভিনব স্বাতন্ত্র দিয়েছে। সমকালীন ভাষাচর্চার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর পরিচ্ছন্ন ধারণা ছিল এবং তিনি অন্তত ভারতীয় ভাষা-সম্পর্কিত রচনাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলেন। তিনি প্রচলিত কাঠামোতে বাংলা ভাষা-বিশ্লেষণের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিলেন। পেশ করেছেন নতুন তত্ত্ব ও প্রণালি-পদ্ধতি। বাংলা ভাষার নিরূপিত কোনো রূপের ভিত্তিতে তিনি ‘ভাষাতত্ত্ব’ রচনা করেননি, খোদ বাংলা ভাষা আবিষ্কারই তাঁর আলোচনা-পর্যালোচনার লক্ষ্য। প্রচলিত অভিধান, ব্যাকরণ আর লিখিত সাহিত্য থেকে উপাত্ত সংগ্রহের পাশাপাশি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে রবীন্দ্রনাথ কথ্য উৎসের আশ্রয় নিয়েছেন। বাংলা ভাষাতত্ত্বের বা বাংলাভাষার ইতিহাসের আলোচকদের মধ্যে একজন অগ্রণী পথিকৃৎ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ । ভাষার উপাদান বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্লেষিত হওয়ার উপায় নেই; যদি করতেই হয়, বৃহত্তর কাঠামোর সাপেক্ষেই করতে হবে । রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের আলোচনায় এ রকমই করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।