সেলিনা হোসেনের "জাতিসত্তাভিত্তিক উপন্যাস" একটি প্রবন্ধধর্মী গ্রন্থ, যেখানে তিনি বাংলা সাহিত্যে জাতিসত্তার পরিচিতি, বিবর্তন ও উপন্যাসে এর প্রকাশ ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটি কোনো কল্পকাহিনি উপন্যাস নয়, বরং জাতিসত্তা ও সাহিত্যতাত্ত্বিক বিশ্লেষণভিত্তিক একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ।
সারমর্ম:
সেলিনা হোসেন এই গ্রন্থে জাতিসত্তা কীভাবে বাংলা উপন্যাসে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে তা বিশ্লেষণ করেন। তিনি দেখান—
কীভাবে ঔপনিবেশিক শাসন, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ জাতিসত্তার গঠনে প্রভাব ফেলেছে।
উপন্যাসে জাতিসত্তার প্রকাশ কেবল বাঙালিত্ব নয়, বরং এর ভেতরে শ্রেণি, লিঙ্গ, সংস্কৃতি, অঞ্চলভিত্তিক বৈচিত্র্য কীভাবে কাজ করে।
বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসসমূহে (যেমন: শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জহির রায়হান, আহমদ ছফা, হাসান আজিজুল হক, ইত্যাদি লেখকদের রচনায়) জাতিসত্তার প্রকাশ কীভাবে ঘটেছে, তার একটি গভীর পাঠ বিশ্লেষণ তিনি করেছেন।
সেলিনা হোসেন দেখান, উপন্যাস শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়— এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক দলিল, যার মাধ্যমে জাতিসত্তার ইতিহাস, সংগ্রাম ও বিকাশ ধরা পড়ে।
এই গ্রন্থে লেখক উপন্যাসকে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা পাঠককে জাতীয় চেতনার সঙ্গে যুক্ত করে এবং একটি জাতির আত্মপরিচয় নির্মাণে ভূমিকা রাখে।
মূল বিষয়গুলো:
জাতিসত্তার সংজ্ঞা ও ধারণা
ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতিসত্তা
উপন্যাসে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা
নারী, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তা চিত্রায়ন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশ
এই বইটি সাহিত্যের শিক্ষার্থী, গবেষক ও পাঠকদের জন্য বিশেষভাবে মূল্যবান।
২১টি উপন্যাস, ৭টি গল্পগ্রন্থ ও ৪টি প্রবন্ধগ্রন্থের রচয়িতা সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। সমকালীন রাজনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্বের উৎস ও প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে সেলিনা হোসেন এর বই সমূহ-তে। সেলিনা হোসেন এর বই সমগ্র অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, রুশসহ একাধিক ভাষায়। প্রবীণ এ লেখিকা ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুন রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। আদি পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীতে হলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। চাকরিসূত্রে তার বাবা রাজশাহী চলে এলে সেটিই হয়ে ওঠে সেলিনার শহর। স্থানীয় এক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। আর ভালোবাসার টানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সেলিনা হোসেন। এরপর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনেও কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি পত্রপত্রিকার জন্য চালিয়ে গেছেন তার কলম। টানা ২০ বছর তিনি ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনা করে পাঠকমনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তার রচিত মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ‘যাপিত জীবন’, ‘ক্ষরণ’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, ‘যুদ্ধ’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ (তিন খণ্ড) ইত্যাদি তার জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘স্বদেশে পরবাসী’, ‘একাত্তরের ঢাকা’, ‘ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন’ ইত্যাদি তার জনপ্রিয় প্রবন্ধ। কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘চাঁদের বুড়ি পান্তা ইলিশ’, ‘আকাশ পরী’, ‘এক রূপোলি নদী’ সহ বেশ কিছু সুপাঠ্য গ্রন্থ। সাহিত্যাঙ্গনে এই অনবদ্য অবদানের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়াও তিনি ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ সহ অসংখ্য পদক পুরস্কার পেয়েছেন।