কত বয়স হলো সাহিত্যের পৃথিবীর? না, জানি না আমরা কেউ । যদি বলি তার বয়স এই বস্তুপৃথিবীর সমান, হয়তো মানবেন না কেউ। কেননা সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে মানুষের হাতে, যে মানুষ বিবর্তনের ধারায় বর্তমান আকৃতি, প্রকৃতি ও অনুভূতি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে এই বস্তুপৃথিবী প্রাণীর বাসযোগ্য হওয়ার অনেক অনেক পরে। তবে সাহিত্য তো কেবল সৃষ্টিকর্ম নয়, সাহিত্য মানে তার উপাদানও বটে । ভাবতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, সাহিত্যের তাবৎ উপাদান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল স্রষ্টা বা স্বয়ম্ভু প্রকৃতির উৎসকল্পনা থেকেই। তাকে নিয়ে আদি গুহামানব থেকে একবিংশ শতাব্দীর উত্তরাধুনিক রোবট পর্যন্ত সকলেই কমবেশি রচনা করেছে নানা কাহিনি । কেবল আবেগবাহিত স্বতঃস্ফূর্ততা নয়, প্রাগ্রসর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিও আজ সাহিত্যের গোত্রভুক্ত। সেই সাহিত্যের বিষয় যেমন কল্পনাশ্রিত ভবিষ্যৎ তেমনি প্রাগৈতিহাসিক অতীতও। এইচ. জি. ওয়েলসের টাইমমেশিন তেমন একটি ব্যতিক্রমী মহৎ সৃষ্টি, যা আমাদের উৎসলীন অতীত ও দূরতম ভবিষ্যতের প্রান্তসীমায় পৌছে দেয়। আর এও স্বীকার্য যে, সাহিত্য কেবল প্রকাশশৈলী নয়, তার বিষয় বা উপাদানও। এই বিচারে সাহিত্যের নির্মাণকলা না হলেও তার উপাদানের বয়স বিশ্বসৃষ্টির সমান বলা অযৌক্তিক নয়। সাহিত্যের পৃথিবী বইয়ে কবি এবং প্রাবন্ধিক মুহম্মদ নূরুল হুদা মহাদেশভিত্তিক সাহিত্যের উৎসমূল অনুসন্ধান করেছেন এবং প্রবণতা বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলা একাডেমি বার্তায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত রচনা এই প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশ হলো ।
মুহম্মদ নূরুল হুদা ১৯৪৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ সেকান্দর ও মাতা আঞ্জুমান আরা বেগম। মূলত কবি তিনি। তবে কথাসাহিত্য, মননশীল প্রবন্ধ ও অনুবাদসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি বিচরণশীল। অতিপ্রজ ও সব্যসাচী এই লেখকের স্বরচিত, অনূদিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা শতাধিক। মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রাপ্ত পুরস্কারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), যশোর সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), আবুল হাসান কবিতা পুরস্কার (১৯৮৩), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কক্সবাজার পদক (১৯৮৯), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৪), আহসান হাবীব কবিতা পুরস্কার (১৯৯৫), যুক্তরাষ্ট্রের আই.এস.সি ঘোষিত পয়েট অব ইন্টারন্যাশনাল মেরিট ও পয়েট অব দ্য ইয়ার (১৯৯৫), কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ কর্তৃক প্রদত্ত নজরুল জন্মশতবার্ষিকী সম্মাননা (১৯৯৯), জীবনানন্দ জন্মশতবার্ষিকী সম্মাননা (১৯৯৯), সুকান্ত পুরস্কার (২০০৪), একুশ-উনিশে ভাষা গৌরব শীর্ষক ত্রিপুরা রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সম্মাননা (২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১২) ইত্যাদি। ১৯৯৭ সালে তিনি তুরস্কের রাষ্ট্রপতি সুলেমান ডেমিরিল কর্তৃক বিশেষ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হন। ২০১৫ সালে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা দিয়ে। তারপর বাংলা একাডেমিতে চাকরি বদল। এখানেই বিকশিত তাঁর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সময়। তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির সদস্য-সচিব। বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের লেখকদের সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সভাপতি। তিনি আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের প্রবক্তা। সাহিত্য-সাধনার পাশাপাশি সাহিত্য-সংগঠক হিসেবেও তিনি সর্বমহলে সমাদৃত।