আঠারো বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই যে ত্বকীকে সারমেয়-প্রতিম ঘাতকের হাতে প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো, সেই ত্বকী যে ছিল একান্ত বিরলসংখ্যক মহাপ্রতিভাধরদেরই একজন- সে ব্যাপারে আমার মনে সামান্যতম সন্দেহও নেই। প্রতিভার বিচারে ত্বকীর তুল্য বিবেচিত হতে পারে, আমার পরিচিতজনদের মধ্যে এমন কাউকেই আমি খুঁজে পাইনি। কিশোর ত্বকীর প্রাত্যহিক জীবনাচরণ দেখে তাকে 'অন্তর্ভূত' (ওহঃৎড়াবৎঃ) চরিত্রসম্পন্ন বলেই মনে হতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে ছিল খুবই প্রাণচঞ্চল ও তীক্ষ্ণধী এক কিশোর। ছিল পরিপার্শ্ব সচেতন। বিরূপ পরিপার্শ্বকে বদলে দেবার তাগিদে অনুক্ষণ সে তাড়িত হতো। নিজের সচেতন কর্মকাণ্ডের ওপর সে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতো, কবি-কিশোর সুকান্তের মতোই 'বিশ্বকে বাসযোগ্য' রূপে গড়ে তোলার প্রত্যয় ছিল তার সমগ্র সত্তায় জড়িত-মিশ্রিত। প্রাণচাঞ্চল্য তাকে উন্মার্গগামিতার দিকে ঠেলে দেয়নি, বরং জীবনসাধনায় সে ছিল একান্ত স্থিতধী। তাই সে অনায়াসে বলতে পেরেছিল- ঘরে ঘরে জ্বলে উঠবে জ্ঞান-প্রীতির আলো,/ থাকবে না হিংসা বিদ্বেষ/ মানুষে সাম্য হবে/ সকলেই এক হবে/ সকলের জ্ঞান হবে/ আকাশ চূড়ায়। [সাম্য] আবার জীবনানন্দের মতোই মৃত্যুর পরে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাবনা হৃদয়ে ধারণ করেও জীবনানন্দীয় ভাববলয়কে অনেক দূর অতিক্রম করে গেছে সে। 'খোদার আসন আরশ ছেদিয়া' ওঠার নজরুলীয় বিদ্রোহেরই নবতন ও স্বকীয় রূপায়ণ ঘটানোর প্রত্যয়-দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল তার কণ্ঠে।
মফিদুল হক (জন্ম: ১৯৪৮) পেশায় প্রকাশক এবং কর্মসুবাদে শিল্প-সংস্কৃতি ও সৃজনমূলক বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। তার সমাজচিন্তামূলক বহুবিধ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও শিল্প-সাহিত্যের সাময়িকীতে, যদিও প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তুলনায় খুব বেশি নয়। মৌলিক প্রবন্ধ রচনার পাশাপাশি অনুবাদেও তিনি সর্বদা আগ্রহের পরিচয় রেখেছেন। সমাজ-অধ্যয়ন তাঁর রচনার মূল বিষয়, এক্ষেত্রে শিল্প-সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ পেয়েছে বিশেষ প্রাধান্য। বাংলা একাডেমী থেকে জীবনীগ্রন্থ সিরিজে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচিত আবুল হাশিম’ এবং পূর্ণেন্দু দস্তিদার' প্রকাশিত উল্লেখযােগ্য অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘মনােজগতে উপনিবেশ: তথ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত’, ‘তৃতীয় বিশ্ব এবং নারীমুক্তির পথিকৃৎ। অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে এর্নেস্তো কার্দেনালের ‘বিপ্লব ও ভালােবাসার কবিতা, জন হের্সের ‘হিরােশিমা', সিডনি শনবার্গের ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ: ১৯৭১', আহমেদ সালিমের ‘পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দিজীবন’ প্রভৃতি। শিল্পকলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে দ্বিভাষিক গ্রন্থ কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটইউনেস্কো প্রকাশিত দ্বিবার্ষিক সংকলন ‘ওয়ার্ল্ড অব থিয়েটার'-এর অন্যতম সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্য-সচিব তিনি।