বিশ শতকের একেবারে শুরুতে ১৩০৮-০৯ বঙ্গাব্দ নাগাদ দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত নব্যভারত পত্রিকায় প্রাণকৃষ্ণ দত্ত “কলিকাতার ইতিবৃত্ত” নামে এমন এক প্রবন্ধমালা লিখতে শুরু করেন, যার জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন। এর অনিয়মিত চোদ্দোটি কিস্তি এক অচেনা কলকাতাকে আমাদের সামনে তুলে ধরে যেখানে কলকাতার উৎপত্তি, স্থাননামের ইতিহাস, প্রাচীন পারিবারিক ইতিকথা, রাস্তাঘাট, স্নান আহ্নিক, ব্যায়াম, ভোজন, সামাজিক ক্রিয়াকলাপ,পূজা, উৎসব, চড়ক, দোল, দুর্গাপুজো থেকে সতীদাহ সবকিছুর এত পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে, মনে হয় যেন নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি।
প্রাণকৃষ্ণের ইচ্ছে থাকলেও এই প্রবন্ধাবলি পুস্তক আকারে তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ পায়নি। আশির দশকের শুরুর দিকে নিশীথরঞ্জন রায়ের ভূমিকা সমৃদ্ধ হয়ে “কলিকাতার ইতিবৃত্ত” নামে দুই মলাটে প্রাণকৃষ্ণের সবকটি লেখা প্রকাশ পায়। দশ বছর বাদে দেবাশিষ বসু এই বইটিকেই পুনরায় সম্পাদিত করে “কলিকাতার ইতিবৃত্ত ও অন্যান্য রচনা” নামে ফের প্রকাশ করেন। এর মধ্যে তিরিশ বছরের বেশি কেটে গেছে। বইটির মূল লেখা পেতে গেলে আর্কাইভ ডট অর্গ কিংবা পুরোনো বইয়ের দোকান ছাড়া গতি নেই। তাই এই বইটিকে আবার পাঠকসমাজে আনার পরিকল্পনা করা হয়। লেখকের মূল টীকাগুলো বাদেও প্রচুর সম্পাদকীয় টীকা, প্রয়োজনীয় ছবি, দুষ্প্রাপ্য মানচিত্র ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে বইটিকে আজকের পাঠকের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। আশা রাখি, কলকাতাপ্রেমী পাঠক বাংলাভাষায় লেখা কলকাতার প্রথম প্রামাণ্য ইতিহাসকে সমসাময়িক আলোতে দেখার এই প্রচেষ্টা আপন করে নেবেন।
হাটখোলার দত্ত পরিবারের ছেলে প্রাণকৃষ্ণ দত্তের লেখা প্রথম (এবং সম্ভবত একমাত্র প্রকাশিত) বইটি বটতলা থেকে প্রকাশ পায় ১৮৬৯ সালে। প্রাণকৃষ্ণ তখন মাত্র সতেরো বছরের কিশোর। ইংরেজ সরকার ১৮৬৮ সালে ইন্ডিয়ান কন্টাজিয়াস ডিজিজ অ্যাক্ট ফোর্টিন বা চৌদ্দ আইন নামে এক আইন চালু করেন। প্রাণকৃষ্ণ এই আইন আর সোনাগাজির বেশ্যাদের উপর এর প্রভাব নিয়ে মাত্র আট পাতার একটি পুস্তিকা লেখেন। নাম বদমাএস জব্দ। তিনি নবপত্রিকা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। নবপত্রিকা প্রকাশের পাঁচ মাস বাদে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় প্রাণকৃষ্ণ দত্ত কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত পদ্যপ্রকাশিকা। নব্যভারতে কলিকাতার ইতিবৃত্তকে পুস্তক আকারে প্রকাশের বাসনা তাঁর ছিল। কিন্তু তার আগেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।