‘ফাঁসির সেল থেকে দেখা বাংলাদেশ’ রাজনীতিবিদ, সংগঠক ও সাংবাদিক কামারুজ্জামানের শেষ রচনা। লেখাটি শুরু হয়েছে পলাশির যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মাধ্যমে বাংলা অঞ্চলের পরাধীনতার সূচনাকালের বিবরণ দিয়ে। তারপর তিনি সংক্ষেপে ধারাবাহিকভাবে বিবরণী টেনেছেন ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমানদের স্বাধিকার আন্দোলনগুলোর। এরপর ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিক থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত মোটামুটি কোথাও সংক্ষিপ্ত কোথাও বিস্তৃতভাবে জাতীয় রাজনীতির একটি স্কেচ এঁকেছেন।
একাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে বইটির সবচেয়ে প্রাণবন্ত অংশের বর্ণনা শুরু হয়েছে। কেননা, এর আগপর্যন্ত যে বয়ান লেখক দিয়ে আসছিলেন, সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে নিছক একজন ইতিহাসপাঠকের পাঠের নির্যাস। কিন্তু একাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে যে বর্ণনা শুরু হয়েছে, সেখানে লেখক কেবল একজন পাঠক বা গবেষক নন; বরং তিনি নিজেই সেই ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী এবং নিজেই একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারও বটে। একজন মেধাবী ছাত্রনেতা থেকে প্রাজ্ঞ জাতীয় নেতার বিবরণীতে দীর্ঘ চার দশকের জাতীয় রাজনীতি ও জামায়াতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি সামগ্রিক ধারণা আমরা এই বইয়ে পেয়ে যাই, যা ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য দলিল বিবেচিত হওয়ার উপযুক্ত।
ঠিক আত্মজীবনী না হলেও ‘ফাঁসির সেল থেকে দেখা বাংলাদেশ’ আত্মজীবনীর যে রস, রূপ, গন্ধ; তার কিছু কিছু আমাদের পাইয়ে দেয়। আবার আত্মজীবনীর যে আত্মবয়ান কিংবা বারবার ‘আমি’ শব্দ উচ্চারণের শ্রুতিকটুতা, তা থেকেও বইটি অনেকাংশে মুক্ত। সব মিলিয়ে এটি একাধারে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির ইতিহাস পুস্তক, রাজনৈতিক বিশ্লেষণাত্মক গ্রন্থ ও আত্মজীবনীমূলক বইয়ের স্বাদ পাইয়ে দেবে পাঠককে।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান রাজনীতিবিদ, সংগঠক ও সাংবাদিক। জন্ম ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর সদরের বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদিপাড়া গ্রামে। শেরপুর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯৭২ সালে মোমেনশাহী নাসিরাবাদ কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ১৯৭৬ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। মাধ্যমিকে পড়াকালেই কামারুজ্জামান ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় হন। ছাত্রশিবির ও জামায়াতে ইসলামী উভয় অঙ্গনেই তিনি শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে সরব ছিলেন। ১৯৭৮-৭৯ সালে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি, ১৯৮২-৯২ সাল পর্যন্ত জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক এবং ১৯৯২-২০১৫ সাল পর্যন্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। কর্মজীবনে মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ঢাকা ডাইজেস্ট-এর নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা-এর সম্পাদক এবং দৈনিক সংগ্রাম-এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। রাজনীতি ও সাংবাদিকতার পাশাপাশি একজন বুদ্ধিজীবী ও লেখক হিসেবেও তিনি খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ ও ইসলাম, আধুনিক যুগে ইসলামী বিপ্লব, ইসলামী নেতৃত্ব, বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী এবং তুরস্ক, ফাঁসির সেল থেকে দেখা বাংলাদেশ প্রভৃতি। ২০১০ সালে জামায়াতের অন্যান্য শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে কামারুজ্জামান কারাবরণ করেন। ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে দশটায় তিনি শাহাদাতবরণ করেন।