আল-ফাওয়াইদ” গ্রন্থ ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহর এক সুপরিচিত রচনা। গ্রন্থটি সাধারণ অন্যান্য বইয়ের মতো অধ্যায়, শিরোনাম ও বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে সাজানো নয়; বরং এক মূল্যবান ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনার সংকলন, যা সময়ের পরতে পরতে তাঁর অন্তর থেকে ঝরে পড়েছিল। এটি সেই উন্নত চিন্তাভাবনার সমষ্টি, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা দান করেন।
.
যখনই তাঁর অন্তরে কোনো জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মুক্তো ঝরতো, তিনি সঙ্গে সঙ্গেই তা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাঁর ভাবনায় হাজির হতো, কিংবা জীবন থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতেন, তিনি তা কাগজের পাতায় কলমের কালি দিয়ে সংরক্ষণ করতেন। এভাবে দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা, তাদাব্বুর এবং আত্মিক উপলব্ধি মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এই অনন্যসাধারণ গ্রন্থ। এক বা দুই সপ্তাহে কিংবা কোন পরিকল্পনা করে বসে লেখা হয়নি এই বইটি; বরং এর রচনাধারা দীর্ঘ সময় ধরে বিকশিত হয়েছে।
.
ফলে গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে বহুমাত্রিক বিষয়বস্তু ও নানারকম সারগর্ভ আলোচনার সমাহার। আকীদা ও তাওহীদ, ঈমান ও কুফর, কুরআন ও তাফসির, হাদীস ও শিক্ষা, অন্তরের প্রকার, গুনাহের কারণ ও প্রভাব, আত্মশুদ্ধি, চিন্তাশীলতা, আল্লাহর দিকে মনোযোগী হওয়া, সালিহ তথা পূণ্যবান ব্যক্তিদের জীবন থেকে শিক্ষা, হৃদয়স্পর্শী কথামালা, বিচিত্র বিষয়ে প্রজ্ঞাময় আলোচনা— সব মিলেমিশে যেন একাকার হয়েছে এখানে।
.
গ্রন্থের ভাঁজে ভাঁজে উপস্থাপিত হৃদয়গ্রাহী নসিহত, সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, গুরুগম্ভীর উপদেশমালা এবং কুরআন-হাদীস ও সালাফের বাণীতে নিহিত দিকনির্দেশনা হৃদয়কে জাগ্রত করবে, অন্তরকে করবে আলোকিত, চিন্তায় আনবে গভীরতা এবং অশান্ত আত্মায় ছড়িয়ে দিবে প্রশান্তির সমীরণ
ইমাম ইবনু কাইয়্যিমিল জাওযীয়া (রহঃ) ছিলেন ইসলামী চিন্তাবিদ, ফকিহ, তাফসীরবিদ, হাদীসজ্ঞ এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের পণ্ডিত। তাঁর পূর্ণ নাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ্ শামসুদ্দ্বীন মুহাম্মাদ বিন আবু বকর বিন আইয়্যুব আদ দিমাশকী। তিনি ৬৯১ হিজরী সালে দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর পিতা দীর্ঘ দিন দামেস্কের আল জাওযীয়া মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বলেই তাঁর পিতা আবু বকরকে قيم الجوزية কাইয়্যিমুল জাওযীয়াহ অর্থাৎ মাদরাসাতুল জাওযীয়ার তত্ত্বাবধায়ক বলা হয়। পরবর্তীতে তাঁর বংশের লোকেরা এই উপাধীতেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমীয়া (রহঃ)-এর স্নেহধন্য শিষ্য ছিলেন এবং শাইখের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর সাথেই ছিলেন। এমনকি জিহাদের ময়দান থেকে শুরু করে জেলখানাতেও তিনি তাঁর থেকে আলাদা হননি। তিনি ইসলামী আকীদাহ, তাওহীদ, সুন্নাহ ও বিদআত-বিরোধী বিভিন্ন বিষয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তার মধ্যে তাওহীদ ও সুন্নাহের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং ইবাদত-বন্দেগীতে নিষ্ঠা ছিল অন্যতম। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
"যাদুল মা‘আদ ফী হাদ্য়ী খাইরিল ইবাদ"
"মাদারিজুস সালিকীন"
"শিফাউল আলীল"
"তিবেব নববী" (চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর অনন্য অবদান)
তাঁর উস্তাদ বৃন্দ -
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) যে সমস্ত আলেম-উলামার কাছ থেকে তালীম ও তারবীয়াত হাসিল করেন, তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ
শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়াহ (রহঃ)।
আহমাদ বিন আব্দুদ্ দায়িম আল-মাকদেসী (রহঃ)।
তাঁর পিতা কাইয়্যিমুল জাওযীয়াহ (রহঃ)।
আহমাদ বিন আব্দুর রহমান আন্ নাবলেসী (রহঃ)।
তাঁর ছাত্রসমূহ -
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) এর হাতে যে সমস্ত মনীষী জ্ঞান আহরণে ধন্য হয়েছিলেন, তাদের তালিকা অতি বিশাল। তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ
বুরহান উদ্দ্বীন ইবরাহীম বিন ইবনুল কাইয়্যিম।
ইমাম ইবনে রজব (রহঃ)।
হাফিয ইমাম ইবনে কাছীর (রহঃ)।
তিনি একজন নিরলস সাধক, যিনি দীর্ঘ সময় ইবাদত করতেন, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ ও কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন থাকতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ইলমী ও আধ্যাত্মিক খেদমত মুসলিম উম্মাহর জন্য অমূল্য দান হয়ে রয়েছে। ইবনুল কাইয়্যিম ৭৫১ হিজরী সনে মারা যান এবং দামেস্কের বাবে সাগীর গোরস্থানে তাঁর পিতার পাশে দাফন করা হয়।