“রাশিয়ার চিঠি" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ প্রায় সত্তর বছর বয়সে ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে (১১ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর) কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সােভিয়েত ইউনিয়নের “বৈদেশিক সাংস্কৃতিক যােগাযােগ সংস্থা” (সংক্ষেপে ‘ভকস’) কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে রাশিয়া ভ্রমণ করেছিলেন। সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন জনকে লেখা চিঠিতে এবং বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি তুলে ধরেছিলেন। সেইসবের সংকলন রাশিয়ার চিঠি শিরােনামে বই আকারে ছাপা হয়েছিল। একদিকে রাশিয়া ভ্রমণ যেমন কবির চিন্তাচেতনার জগতে বড় ধরনের উত্তরণ ঘটিয়েছিল, তেমনি রাশিয়ার চিঠি গ্রন্থটি সেই যুগে বিরাট আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশে রুশ বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রকে কিছুটা জনপ্রিয় করে তুলতেও সাহায্য করেছিল। রাশিয়ার চিঠি ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হলে ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছিল। এটা ছিল সেই সময়, যখন ব্রিটিশ ভারতে কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট পার্টি ছিল বেআইনি। কমরেড মুজাফফর আহমদসহ অনেকের বিরুদ্ধে কমিউনিজম প্রচার করার অপরাধে ঐতিহাসিক মিরাট ষড়যন্ত্র মামলাসহ প্রকাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কমিউনিস্ট মানেই অপরাধী। তখন কমিউনিস্টদের ধরে ধরে বন্দি করা হচ্ছে। এটা ছিল সেই সময়, যখন কমিউনিজম, মার্কসবাদ, বিপ্লবী রাশিয়া এবং বিপ্লবের নেতা লেনিন ও স্তালিন সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া মহল থেকে সবরকমের মিথ্যা অপপ্রচার চালানাে হচ্ছে। বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সাম্রাজ্যবাদীদের দালালে পরিণত হয়েছেন অথবা প্রচার দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছেন। সােভিয়েত সরকার তাই বিভিন্ন দেশ থেকে বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিকদের আমন্ত্রণ জানাতেন সােভিয়েত দেশ দেখে আসার জন্য। অনেক বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী সমাজতান্ত্রিক দেশে বিভিন্ন দিক দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মার্কসবাদী নন, এমন অনেক বুদ্ধিজীবী বা শিল্পী-সাহিত্যিকও সােভিয়েত সমাজকে নতুন সভ্যতার অভ্যুদয় বলে ঘােষণা করেছিলেন। বিখ্যাত ব্রিটিশ নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ অথবা ফরাসি ঔপন্যাসিক রােমা রােলা সােভিয়েত সমাজতন্ত্রে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। বার্নার্ড শ প্রথমে সােভিয়েত রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বেশ সমালােচক ছিলেন। তিনি ছিলেন ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রী। তবে স্তালিনের সঙ্গে আলােচনার পর তার ভুল ভেঙেছিল ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।