কমলা সবুজকে একটা প্লাস্টিকের ওয়াড্রোব কিনে দিয়েছিল। এটা যে কমলাই কিনে দিয়েছিল এ-কথাটা সবুজ সাহস করে হাসিকে বলতে পারেনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ও ঠেকে শিখেছে যে, নিজের ভালোর জন্যে, সংসারের শান্তির জন্যে কিছু কিছু মিথ্যা কথা বলা ভালো। মানে, শুধু ভালোই নয়, তা না বললে, সমূহ বিপদ।
আজ অফিস থেকে ফিরে, নোনা-ধরা দেওয়ালে ঝুলতে-থাকা ওয়াড্রোবটা খুলে, তা থেকে হ্যাঙার বের করে হাওয়াইন্ শার্টটা যত্ন করে তুলে রাখল ও। প্যান্টটাও। এই প্লাস্টিকের হ্যাঙারগুলোও ওয়াড্রোবের সঙ্গেই কিনে দিয়েছিল কমলা।
বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ হয়েছে। সারাদিন বড় ভ্যাপসা গুমোট গরম গেছে। বাড়ির আলসের ওপর, কাচের জানালায়, গলির ও-পাশের তেলেভাজার দোকানের টিনের ছাদের ওপর বৃষ্টির টিপটিপানি আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। গরম পিচের পথে প্রথম বৃষ্টি পড়ায় একটা গন্ধ বেরুচ্ছে। সবুজ তার জামা-প্যান্ট খুলে, উল্লা-গায়ে শুধু আন্ডারওয়্যার পরে, ঘরের বাতি নিভিয়ে অনেকক্ষণ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রইল। এই সময়টুকুতে তার অফিসের, তার একঘেয়ে জীবনের, তার সংসারের সমস্ত রকম দাবি থেকে ও নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং বিচ্ছিন্ন করে ও একেবারে নিজের, একেবারে একারই হয়ে গিয়ে ওদের বাসার সামনের বৃষ্টি-ভেজা গলিটুকুর দিকে তাকিয়ে থাকে।
হাসি হঠাৎ এসে ঘরে ঢুকল। অনুযোগের গলায় ওকে, চান করে নাও না। কী-যে সারাদিন পর বাড়ি ফিরে এসে অন্ধকার ঘরে বসে থাকো, বুঝতে পারি না। বলেই সবুজের উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার যেমনভাবে এসেছিল, তেমনভাবেই ফিরে গেল রান্নাঘরের দিকে।
বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার মাধ্যমে পাঠকহৃদয় জয় করে নেওয়া এই লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। বুদ্ধদেব গুহ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন, যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধেয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য। এর সাথে তিনি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যা তাকে খুব সহজেই খ্যাতির পাত্রে পরিণত করে। বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। এর মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহ এর উপন্যাস সমগ্র হলো ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ঋজুদা’ সিরিজ। তাঁর রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাস একইসাথে বিতর্কিত ও তুমুল জনপ্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং একজন নামকরা সঙ্গীতশিল্পীও বটে। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন।