বাংলার নাট্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একেবারে শুরু থেকেই একটি স্বাধীন নাট্যমঞ্চের স্বপ্ন দেখেছিলেনÑযে নাট্যমঞ্চে থাকবে না কোনো ভাবপ্রকাশের কৃত্রিম বন্ধন, থাকবে না দৃশ্যপট পরিবর্তনের কৃত্রিম শৃঙ্খলা। এমনকি নাটকের লিখিত পাণ্ডুলিপি জুড়ে দৃশ্য-অঙ্ক বিভাজনের অসারতাও তিনিই টের পেয়েছিলেন। তাই তাঁর শেষপর্বের নাটকগুলিতে দৃশ্য বিভাজনের কড়া অনুশাসন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানেন নি, আবার দৃশ্য বর্ণনার ব্রাকেটে আবদ্ধ প্রচলিত নিয়মকে উপেক্ষা করে কোনো কোনো নাটকে বর্ণনাকে মুক্তি দিয়েছেন ব্রাকেটের বন্ধন থেকে। এই গ্রন্থে রবীন্দ্্রনাথের সমগ্র জীবনের নাট্য বিষয়ক চিন্তা, নাট্য রচনা, নাট্য মঞ্চায়নের পূর্বাপর অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথের নিজের রচনা থেকেই সংকলিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের নাট্যকার ও গবেষক সাইমন জাকারিয়া সংকলিত ও সম্পাদিত এই গ্রন্থ পাঠে পাঠক খুব সহজেই রবীন্দ্রনাথের নাট্যচিন্তার ক্রমবিকাশ ও পর্যায়গুলি উপলব্ধি করতে পারবেন। সাইমন জাকারিয়া, নাটক রচনায় ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেছেন। একই সঙ্গে জাতীয়তাবোধ ও আন্তর্জাতিক চেতনা ধারণ করেছে তার নাটক। এ কারণে তার নাটক বাংলাদেশের গি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম লে সমাদৃত। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে সাইমন জাকারিয়া-র নাটক প্রযোজিত হয়েছে। এছাড়া, আমেরিকা-র দি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো-র সাউথ এশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন ডিপার্টমেন্টে পড়ানো হয়েছে তার নাটক। সাইমনের রচিত ও মঞ্চস্থ উল্লেখযোগ্য নাট্যপ্রযোজনাÑ মঞ্চনাটকÑ শুরু করি ভূমির নামে, ন নৈরামণি এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, বিনোদিনী, সীতার অগ্নিপরীক্ষা ইত্যাদি, আবৃত্তিনাটকÑ ন নৈরামণি ও হলুদ পাতার গান; নৃত্যনাট্যÑ ঋতুঅভিযান। নাটক রচনা ও গবেষণার জন্য অর্জন করেছেনÑ সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার-২০১২ (যৌথভাবে), প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার ১৪১৫, কালি ও কলম-এইচএসবিসি তরুণ লেখক পুরস্কার ২০০৮ ও বাংলাদেশ টেলিভিশন দর্শক ফোরাম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার পদক ২০০৪। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: গবেষণাÑপ্রাচীন বাংলার বুদ্ধ নাটক, বাংলাদেশের লোকনাটক: বিষয় ও আঙ্গিক-বৈচিত্র্য, রবীন্দ্রনাথ: জনমানুষের কাছে, প্রণমহি বঙ্গমাতা ইত্যাদি, কাব্য- সদানন্দের সংসারে, আনন্দময়ীর আগমনে, উপন্যাস- কে তাহারে চিনতে পারে ইত্যাদি। জন্ম ৩ ডিসেম্বর ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার জুঙ্গলি গ্রামে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।