“নীলমানুষ” বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছােটদের মনের খুব কাছাকাছি থাকা মানুষ ছিলেন; তা সকলেরই জানা। ছােটদের, অর্থাৎ কিশাের-বয়সি পাঠকের জন্য সুনীলের সৃষ্টিতে বৈচিত্র্য বড় কম ছিল না! সেই বৈচিত্র্যের অনন্য স্বাক্ষর রয়েছে রণজয় চরিত্রটিতে। সেই ষাট বা সত্তরের দশকের প্রথমদিকে বাংলা কল্পবিজ্ঞান কাহিনির ধারাটি, বােধকরি কিছুটা ক্ষীণকায়া ছিল। মৌলিক কল্পবিজ্ঞান কাহিনি সংখ্যায় ছিল হাতে-গােনা। এ-সময়ে সৃষ্ট এই রণজয়, অর্থাৎ নীলমানুষ কিশাের-সাহিত্য এবং কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের শাখাকে অনেকটাই সতেজ করে দেয়।। গ্রামের একেবারে সিধে-সরল এক যুবক রণজয় বিশ্বাসের দুর্ভাগ্যক্রমে গ্রহান্তরের দুষ্টু লােকদের পাল্লায় পড়ে রূপান্তর ঘটল নীলবর্ণের মানবে। সে হয়ে গেল পরিপূর্ণ নীল রঙের মানুষ। তার শারীরিক শক্তিও হয়ে উঠল প্রবল। এই রণজয় কিংবা নীল মানুষকে মুখ্য চরিত্রে এনে সুনীল লিখে গেছেন একের পর এক কাহিনি। তার মধ্যে যেমন আছে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ, গল্পের টান টান রােমহর্ষতা, তেমনই সব কিছুকে ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে নিবিড় মানবিক আবেদন। কল্পবিজ্ঞানের গল্প সুনীলের নিজস্ব শৈলীতে হয়ে উঠেছে মানষের আখ্যান। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদে পূর্ণ রক্তমাংসের মানুষের কাহিনি যেমন হয়। নীল মানুষকে নিয়ে সুনীলের লেখা একগুচ্ছ গল্পই এই সংগ্রহে সাজিয়ে দেওয়া হল। আশা রাখি, ছােটদের সঙ্গে বড়রাও বিমুখ হবেন না।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।