বাড়ী-বুড়ো-বুট
হেমেন্দ্রকুমার রায়
বাড়ীখানি ভারি ভালো লাগল। চারিধারে বাগান—যদিও ফুলগাছের চেয়ে বড় বড় গাছই বেশি। টেনিস-খেলার জমি, মাঝে মাঝে শ্বেতপাথরের বেদী, একটি ছোট বাহারী ফোয়ারা, এখানে-ওখানে লাল কাঁকর-বিছানো পথ।
দোতলা বাড়ী—একেবারে হাল-ফ্যাসানের না হলেও সেকেলে নয়। বাড়ীর জানলায় বা দেয়ালে প্রাচীনতার কোন চিহ্নই নেই। কোথাও ফাট ধরেনি, কোথাও অশথ-বট এসে জোর ক'রে জুড়ে বসেনি ।
কিন্তু তবু মনে হল, বাড়ীখানি যেন রহস্যময়। ভাবলুম, বাড়ীর মাথা ছাড়িয়ে উঠে মস্ত মস্ত গাছগুলো নিজেদের জন্যে একটি ছায়ার জগৎ সৃষ্টি করেছে ব'লেই হয়তো এখানে এমন রহস্যের আবহ গ'ড়ে উঠেছে। আমার পক্ষে এও এক আকর্ষণ। আমি রহস্য ভালোবাসি, রহস্যের মধ্যে থাকে ‘রোমান্সে’র গন্ধ।
সাঁওতাল পরগণার একটি জায়গা। স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়েদের বায়ু পরিবর্তনের দরকার— ডাক্তারের মতে এ-জায়গাটি নাকি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। বন্ধু প্রকাশের সঙ্গে এখানে এসেছি, মনের মতন একটি বাড়ী খুঁজে নিতে। আজকের ট্রেনেই কলকাতায় ফিরব।
খানিক ডাকাডাকির পর বাগানের ভিতর থেকে একটি লোক বেরিয়ে এল— তার চেহারা না মালী, না দ্বারবান, না ভদ্র বা ইতর লোকের মতো। তার বয়স আশীও হতে পারে, একশোও হ'তে পারে! তার মাথায় ধবধবে সাদা, এলোমেলো লম্বা লম্বা চুল। তার কোমর এমন ভাঙা যে হাড়-জিরজিরে দেহের উপর-অংশ একেবারে দুমড়ে পড়েছে। কিন্তু হাতের লাঠি ঠঠকিয়ে সে এত তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল যে, তার অসম্ভব ক্ষিপ্রতা দেখে বিস্মিত হলুম।
সে জিজ্ঞাসা করলে, “আপনারা কি চান?”
—“বাড়ীর ফটকের উপরে লেখা রয়েছে— টু লেট্'। আমরা এই বাড়ীখানা ভাড়া নিতে চাই।”
লোকটা হঠাৎ মুখ তুলে তাকালো। সে এতক্ষণ মাথা হেঁট ক'রে ছিল বলে তার চোখ দেখতে পাইনি। এখনো দেখতে পেলুম না, কারণ তার চোখ দুটো এমনি অস্বাভাবিক-ভাবে কোটরগত যে, প্রথম দৃষ্টিতে তাদের আবিষ্কার করাই যায় না! মনে হয়, লোকটা বুঝি অন্ধ। কিন্তু তারপর লক্ষ্য ক'রে দেখলুম, দুটো কোটরের ভিতর দিকে কি যেন চক্চক্ করছে—দুই অন্ধকার গর্তের মধ্যে যেন দুই দীপশিখার ইঙ্গিত।
লোকটা আবার মুখ নামিয়ে ফেলে থেমে থেমে বললে, “ভাড়া নিতে চান? এই বাড়ী ভাড়া নিতে চান? বেশ!”
—“বাড়ীখানা আমাদের পছন্দ হয়েছে! এ বাড়ীর মালিক কে?”