মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় মানুষ প্রজাতিটি সঠিক ভাবে গড়ে উঠেনি। তাদের বুকের ভেতর এতো গভীর ভালোবাসা দেয়া ঠিক হয়নি, তাদের হৃদয়টাকে আবো একটু কঠিন করে তৈরি করা উচিৎ ছিল। একজন মা কিংবা বাবা তার সন্তানকে এতো গভীরভাবে ভালোবাসে যে, সেই তীব্র ভালোবাসার কাছাকাছি আর কিছু এই সৃষ্টি জগতে নেই। সেই সন্তানকে হঠাৎ যদি বুকের ভেতর থেকে টেনে ছিঁড়ে নেয়া হয়, তাহলে মা-বাবার বুকের ভেতর যে হাহাকারের জন্ম হয়, সেই হাহাকারকে ধারণ করার মত কঠিন কোনো পাত্র এই সৃষ্টি জগতে নেই। তাই যদি সত্যি হবে তাহলে প্রকৃতি কেনো একজন বাবা কিংবা মায়ের বুক খালি করে সেই সন্তানকে কেড়ে নিয়ে তাদেরকে অচিন্তনীয় শূন্যতার মাঝে ঠেলে দেয়?
বেশ কিছুদিন আগে শ্রীমঙ্গলের একজন স্কুল শিক্ষক রাজকুমার সিংহ আমার কাছে বিশাল একটা পাণ্ডুলিপি নিয়ে এসেছিলেন। তিনি যখন পাণ্ডুলিপিটির বিষয়বস্তু আমার কাছে বর্ণনা করলেন তখন আমি একটা ধাক্কা খেলাম। তাঁর সাড়ে নয় বছরের মেয়ে মৈত্রেয়ী হঠাৎ করে ভয়াবহ একটা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মেয়ে হারানোর কষ্টটি ভুলে থাকার জন্যে তিনি এই বইটি লিখেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়, চিকিৎসার জন্যে ভেলুড় গিয়ে "আধমরা এবং আধপাগল" অবস্থায় লিখতে শুরু করেছিলেন। হাসপাতালের বারান্দায়, হোটেলে, লাইনে অপেক্ষমাণ থেকে, ডেথ সার্টিফিকেটের জন্যে ডাক্তারের চেম্বারের সামনে, থানার বারান্দায়, ট্রেনে, এম্বুলেন্সে চলার পথে তিনি বুকের রক্ত দিয়ে একটু একটু করে লিখেছেন। তাঁর ভাষায়, "এ কাহিনী লেখা শেষ হওয়ার আগে আমি মরতে চাই না, লেখা শেষ হওয়ার পর মরে গেলে আমার কোন আফসোস নেই।"
রাজকুমার সিংহ আমার কাছে তাঁর পাণ্ডুলিপিটা রেখে গিয়েছিলেন আমি খুব বেশিদূর পড়তে পারিনি। ব্যস্ততা, সময়ের অভাব সেগুলো মূল কারণ নয়, এরকম নির্মম নিষ্ঠুর কঠোর বাস্তবতা পড়ার মত সাহস কিংবা মনের জোর আমার নেই। এটি কাঁচা হাতের দুর্বল আবেগাশ্রয়ী লেখা নয়, এটি একজন দক্ষ লেখকের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। এরকম নির্মম একটি লেখা আমি আগে কখনো পড়েছি বলে মনে পড়ে না।
'মৈত্রেয়ী নেই মৈত্রেয়ী আছে' বইটিকে রাজকুমার সিংহ একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস হিসাবে অভিহিত করেছেন, এটি তার থেকেও অনেক বেশি। এটি কিশোরী একটি মেয়ের জন্য তার বাবার একটি স্মৃতিসৌধ। এটি একটি বই নয়, এটি বুকের রক্ত দিয়ে লেখা ভালোবাসার একটি বিষাদ গাঁথা।
আমি শিশু-কিশোরদের জন্যে লিখি, তাই তাদের সাথে আমার একটা ভালোবাসার সম্পক আছে। তাদের পাঠানো অনেক ছবি, চিঠি, কার্ড আমি আমার অফিসের দেওয়ালে টানিয়ে রাখি। রাজকুমার সিংহ যাবার আগে আমাকে মৈত্রেয়ীর একটা ছবি দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটি আমি আমার অফিসের দেওয়ালে টানিয়ে রেখেছি। মৈত্রেয়ী সেই দেওয়াল থেকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, একটি নিষ্ঠুর পৃথিবীতে এই ছোট কিশোরীটিকে কেন ধরে রাখার জায়গা হলো না, আমি বোঝার চেষ্টা করি।