স্বর্গ-মর্ত্য-নরক কি বেহেস্ত-দোজখ নিয়ে এ দেশে-বিদেশে কবি-কথাকার অনেকেই অনেক কাব্য-কাহিনি লিখেছেন। কিন্তু বিভূতিভূষণের দেবযান কোনােদিক থেকেই কারও সঙ্গে তুলনীয় নয়। কেবল বিষয়বস্তু, মননশীলতা, রচনাশৈলী ব ভাষাভঙ্গিমায় নয়—দেবযান-এর অনন্যতা তার। অন্তলীন বাস্তবতার স্বাতন্ত্রে। উপনিষদের ‘ব্রহ্মচক্র বা ভগবদগীতায় উক্ত ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে বাণীকেই বিশ্লেষণ করে, বিশাল পটভূমিকায় যেভাবে উপন্যাসাকারে পৌছে দেওয়া হয়েছে পাঠকচিত্তে তা এক-কথায় অনন্যসাধারণ। অনবদ্য কল্পনার আশ্রয়ে ব্রহ্মাণ্ডের চিত্ররূপময় আলেখ্য তিনি তার অননুকরণীয় ভাষায় যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, সংবেদনশীল পাঠক-মন তাতে বিস্ময়বােধ না করে পারে না। দেব্যান-এ ভুবলোক সৃষ্টির আনন্দে বিভাের বিভূতিভূষণ আসলে সৃষ্টি করেছেন প্রেমে ভুবন—যার মুখ্য কুশীলব যতীন ও পুষ্প, শৈশবে যারা ছিল একে অপরের খেলার সাথি। ইহজীবনের মতাে পরজীবনেও তাদের মিলন হয়নি কিন্তু অমর প্রেমের বাঁধনেই বাঁধা রয়েছে তারা—পুনর্জন্ম নিয়ে যতীন ফিরে এসেছে পৃথিবীতে। অশরীরী পুষ্প । গঙ্গার ঘাটে বসে পৃথিবীর রূপ দেখে আর ভাবে। ‘এই তাে আমাদের পৃথিবী, আমাদের স্বর্গ। ভগবা এখানে কত ফুলে-ফলে নিজেকে ধরা দেন, কত জ্যোৎস্নার আলােয়, কত অসহায় শিশুর হাসিতে।...চিনলাম...আমাদের মাটির স্বর্গকে.. মানুষকে মানুষই মাটি দিয়ে গড়া দেবতা—দুদিন পরে সত্যিকার দেবতা হয়ে যাবে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।