"পুতুলনাচের ইতিকথা" — মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এই উপন্যাসটি মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সমাজব্যবস্থা এবং নিয়তির টানাপোড়েনকে তুলে ধরে। নিচে এর সারমর্ম দেওয়া হলো:
📘 সারমর্ম:
"পুতুলনাচের ইতিকথা" উপন্যাসটি মূলত তিনটি চরিত্র—শশী, কিরণ ও দয়ালের জীবনের গল্প। শশী একজন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবক, যার চিন্তাভাবনায় আধুনিকতার ছাপ আছে, কিন্তু সমাজের রক্ষণশীলতার সঙ্গে তার একটা দ্বন্দ্ব চলছে। কিরণ, এক স্বাধীনচেতা ও আত্মবিশ্বাসী নারী, যে শশীর প্রেমিকা হলেও পরে সমাজ ও বাস্তবতার চাপে অন্যত্র বিয়ে করে। দয়াল একজন ভবঘুরে দার্শনিক, যে সমাজকে দূর থেকে দেখে এবং তার নিজের তত্ত্বে বিশ্বাস করে চলে।
উপন্যাসের নাম "পুতুলনাচের ইতিকথা" নিজেই এর প্রতীক — এখানে মানুষদের পুতুলের মতো মনে করা হয়েছে, যারা সমাজ ও নিয়তির হাতে বাঁধা পড়ে নাচছে, নিজের ইচ্ছায় নয়। তারা সমাজের সৃষ্টি করা কাঠামোয় আটকে গেছে, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হয়।
🔍 মূল বিষয়বস্তু ও বার্তা:
সমাজব্যবস্থার কঠোরতা
ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বনাম সামাজিক দায়িত্ব
নিয়তির হাতে মানুষের অসহায়তা
সম্পর্কের জটিলতা ও মানসিক দ্বন্দ্ব
এই উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মানবজীবনের গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সমাজের নিপীড়নমূলক কাঠামোর ছবি এঁকেছেন। এটি শুধু একটি প্রেমকাহিনি নয়, বরং আধুনিকতার ছোঁয়ায় মোড়ানো এক দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক দলিল।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।