“সংশপ্তক” শব্দের অর্থ—যারা মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করে যায়, পিছু হটে না। উপন্যাসটিতে শহীদুল্লা কায়সার এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষদের জীবনের গল্প বলেছেন, যারা অন্যায়, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায়।
“সংশপ্তক” শহীদুল্লা কায়সার রচিত একটি বিখ্যাত উপন্যাস, যা বাংলাদেশের ইতিহাস, সমাজ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত এক অনন্য সাহিত্যকর্ম। এটি মূলত ১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে শুরু করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত সময়কালকে ঘিরে রচিত। নিচে উপন্যাসটির সারমর্ম দেওয়া হলো:
সারমর্ম:
“সংশপ্তক” শব্দের অর্থ—যারা মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করে যায়, পিছু হটে না। উপন্যাসটিতে শহীদুল্লা কায়সার এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষদের জীবনের গল্প বলেছেন, যারা অন্যায়, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায়।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিতাই চরণ—একজন আদর্শবাদী মানুষ। তিনি সামন্তবাদী সমাজে অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তাঁর ছেলে শঙ্খ, মেয়ে মীনা এবং স্ত্রী শশী—সবাই নানা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যান।
উপন্যাসে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের চরিত্র উঠে এসেছে, যেমন—জমিদার, মধ্যবিত্ত, কৃষক, মেহনতি মানুষ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। এর মধ্য দিয়ে লেখক বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়, সংগ্রাম ও জাগরণের চিত্র তুলে ধরেছেন।
একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদিকে ভাষা ও সংস্কৃতির সংকট—এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট উপন্যাসে অত্যন্ত প্রাণবন্তভাবে চিত্রিত হয়েছে।
মূল থিম ও বার্তা:
শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
আদর্শের প্রতি অটল থাকা
সমাজে পরিবর্তনের জন্য আত্মত্যাগ
ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা
মানুষের জাগরণ ও আত্মমর্যাদাবোধ
এই উপন্যাস শুধু একটি পারিবারিক কাহিনি নয়, বরং একটি জাতির জাগরণ ও ইতিহাসের ধারাবাহিক রূপায়ণ।
Shahidullah Kaiser শহীদুল্লা কায়সার ১৯২৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার মাজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। একজন বাঙালি লেখক ও বুদ্ধিজীবী। পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর বাবার নাম মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ্ এবং মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন ৷ 'সরকারি মডেল স্কুলে' এবং পরে 'মাদরাসা-ই-আলিয়া'র অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি ভর্তি হন 'প্রেসিডেন্সি কলেজে'৷ ১৯৪৬ সালে তিনি এখান থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন এবং অর্থনীতিতে এমএ পড়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ৷ একই সাথে তিনি 'রিপন কলেজে' (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজ) আইন বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করেন৷ ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তাঁর বাবা ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ ভর্তি হন। তবে এ ডিগ্রি লাভ করার আগেই পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটান। শহীদুল্লা কায়সার ১৯৫৬ সালে কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিচালিত 'সাপ্তাহিক ইত্তেফাক' পত্রিকায় যোগদান করেন৷ এভাবেই তিনি যুক্ত হন সাংবাদিকতায়। পরবর্তীতে তিনি ১৯৫৮ সালে 'দৈনিক সংবাদ'-এর সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক আইন জারি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৪ অক্টোবর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়৷ জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে এ পর্যায়ে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আটক রাখা হয়৷ মুক্তি লাভ করেই তিনি 'দৈনিক সংবাদ'-এর সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেন৷ 'সাপ্তাহিক ইত্তেফাক' পত্রিকা থেকে সাংবাদিক জীবনের হাতেখড়ি হলেও তাঁর সাংবাদিক জীবনের সমস্ত কৃতিত্ব ও পরিচিতি 'দৈনিক সংবাদ'-কে ঘিরে আবর্তিত৷ শহীদুল্লা কায়সার দুইবার বিয়ে করেছিলেন। তিনি প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যমন্ত্রী ও চিকিৎসক আর আহমেদের কন্যা জোহরা খাতুনকে বিয়ে করেন। বিবাহবিচ্ছেদের পরে শহীদুল্লা কায়সার ১৯৬৯ সালে পান্না চৌধুরীকে বিয়ে করেন। পান্না কায়সার ১৯৯৬-২০০১ সালের জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ ছিলেন। তাঁদের দুইটি সন্তান, অমি কায়সার ও শমী কায়সার। শমী টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনেত্রী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। পুরস্কার আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬২), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২) স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৮) মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাঁর বাসা ২৯ বি কে গাঙ্গুলী লেন থেকে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার স্থানীয় সহযোগী আল-বদরের হাতে অপহৃত হন। ধারণা করা হয় যে, অপহরণকারীদের হাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।