"পূরবী" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: পূরবী রীতিমতাে অভিনব । রবীন্দ্রজীবনে বন্ধ্যা সময় এসেছে খুব কমই। তারই মধ্যে একটা পর্যায়ে খরা এসেছিলাে ক বছরের জন্যে। কাব্যলক্ষ্মীকে দূরে রেখে তখন তিনি ছিলেন ব্যতিব্যস্ত বস্তুজগতে। সে সময়েরই একটা পর্বে কার্যকারণে তিনি সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন দক্ষিণ অ্যামেরিকার পথে। অমনি কোথা থেকে অকস্মাৎ করুণাধারার মতাে নেমে এসেছিলাে কাব্যের বারিধারা, যদিও তার প্রেরণা ছিলাে পুরােনাে প্রেমের, দিনশেষের রাগিণীতে। কিন্তু কী আশ্চর্য! সিন্ধুপারে পৌঁছেই তিনি দেখা পেলেন সেই নারীর, এতােদিন পথ চেয়ে আর কাল গুনে বসেছিলেন যার জন্যে । যেন দুজন দুজনের জন্যে অপেক্ষায় করেইছিলেন-বার্ধক্যে উপনীত কবি, আর বিদুষী তরুণী, ভিক্তোরিয়া কবির বয়স সাড়ে ৬৩, আর ভিক্তোরিয়ার ৩৪ । শ্রবণে নয়, কবি ডাক শুনতে পান তার অন্তরের অন্তস্তলে । হৃদয়ে তার প্রবল দোলা লাগে । আকস্মিক কিন্তু সুতীব্র এক অনুভূতিতে তিনি হলেন হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, আর শুধানাের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ মুখ-চেয়ে-থাকা তাঁর অনুরাগিণী । স্বপ্ন বিয়ােগান্ত জেনেও কবি বলেন, তােমার দেখার স্মৃতি নিয়ে/একলা আমি যাব ফিরে ।... ফিরে দেখা হবে না তাে আর । ফেলে দিয়ে ভােরে-গাঁথা ম্লান মল্লিকার মালাখানি। সেই হবে স্পর্শ তব, সেই হবে বিদায়ের বাণী। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ভিজোরিয়ার প্রতি কবির হৃদয়ে গভীর ভালােবাসা জাগ্রত ছিলাে। মৃত্যুর অল্প আগেও ভিক্তোরিয়ার স্মৃতিচিহ্ন একটি আসন নিয়ে একাধিক কবিতা লিখেছেন। তাঁর এ ভালােবাসা একমাত্র । কাদম্বরী দেবীর প্রতি তার ভালােবাসার সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলাে : পূরবীতে এসে কবির রুদ্ধ সৃজনশীলতার অর্গল ভেঙে যাওয়ার পর থেকে আমৃত্যু তা আর কখনাে রুদ্ধ হয়নি । পূরবী ক্রান্তিকালের কাব্য, বাঁধ ভাঙার কাব্য, রবীন্দ্রপ্রতিভার পুনর্জাগরণের কাব্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।